সদ্যজাত বাছুরের যত্ন ও পরিচর্যা

স্তন্যপায়ী প্রায় সকল প্রাণীর জন্মপ্রক্রিয়া একই হলেও কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে জন্ম পরবর্তী নিবিড় যত্ন দরকার হয়। আমাদের দেশে ঘাস আর খড়ের উপর নির্ভর করে পালন করা দেশি গরুতে বাছুরের জন্ম পরবর্তী জটিলতা হতোনা বললেই চলে কারণ একদিকে গর্ভাবস্তায় গরু যেমন পর্যাপ্ত পরিমান পুষ্টিকর ঘাস পেতো আবার অন্যদিকে গরুও ছিলো শক্ত জাতের। কিক্ত বর্তমান বাস্তবতায় বিদেশী ক্রস জাতের গাভী এবং বাছুরের জন্য জন্ম পরবর্তী নিবিড় পরিচর্যা জরুরি। যেকোনো প্রাণী ভূমিষ্ট হওয়ার পরে খুব অসহায় অবস্থায় থাকে এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাকে সুস্থ সবল করে তুলতে হয়। জন্ম পরবর্তী পরিচর্যার উপরেই একটা বাছুরের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভরশীল। ভূমিষ্ট হওয়ার পরে একটা বাছুরের যত্নে প্রধান করণীয় পর্যায়ক্রমিক কাজ গুলো হচ্ছ:

প্রাথমিক পরিচর্যা ও যত্ন : বাছুরের জন্মের পরপরই পরিস্কার ব্লেড দিয়ে নাভী কেটে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে কাটার পর স্থানটিতে টিংচার আয়োডিন বা টিংচার বেনজিন জাতীয় জীবাণুনাশক উষধ লাগাতে হবে। এর ফলে নাভি দিয়ে রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না বাচ্চা প্রসবের পরপরই বাচ্চার নাক ও মুখের লালা ও ঝিলই পরিস্কার করে দিতে হবে। নতুবা স্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে পারে যদি বাছুর প্রসব হওয়ার পর শ্বাসপ্রশ্বাস না নেয় চাপ দিয়ে স্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করা যায়। এছাড়া বাছুরের নাকে-মুখে ফুঁ দিয়েও শ্বাস প্রশ্বাস চালু করা যায়। বাছুরের নাক মুখ পরিষ্কারের পর গাভীর সামনে শুকনো খড় বিছিয়ে রাখলে গাতী চেটে বাচ্চার গা পরিস্কার করে দেয়। এরপর শুকনো নরম খড়, কাপড় অথবা চট দিয়ে বাছুরের গা ভাল করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। শীতে বা অতিরিক্ত ঠান্ডায় শুকনো কাপড় বা চট দিয়ে বাছুরকে ঢেকে দিতে হবে। অথবা আগুন জ্বালিয়ে বাছুরের শরীর গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থসবল বাছুর জন্মের ১৫ মিনিট পর থেকেই উঠার চেষ্টা করে এবং দুধ খেতে সক্ষম হয়। অনেক সময় বাছুর নিজের চেষ্টায় দাঁড়াতে ও দুধ খেতে পারে না। এ অবস্থায় বাছুরকে দাঁড়াতে ও দুধ খাওয়াতে সাহায্য করতে হবে। প্রসবের ১-২ ঘন্টার মধ্যে বাছুরকে তার মায়ের শালদুধ খাওয়াতে হবে। যদি বাছুর দুর্বলতার কারণে দাঁড়াতে বা দুধ খেতে না পারে তবে বোতলে নিপল লাগিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে।

সদ্যজাত বাছুরের বাসস্থান ব্যবস্থাপনা: বাছুরের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান বাছুরকে রোগমুক্ত রাখার প্রধান সহায়ক। বাছুরকে রোগমুক্ত রাখার জন্য তাদেরকে পৃথক ঘরে রাখতে হবে এবং এর ফলে প্রতিটি বাছুরের রক্ষণাবেক্ষণ সহজতর হয়। অনেক বাছুর একসাথে থাকলে দুর্বল বাছুরগুলো সবল বাছুরদের সাথে প্রতিদবন্দিতা করে প্রয়োজন মাফিক খাবার খেতে পারেনা এবং আরো দূর্বল হয়ে পড়ে। বাছুরের ঘর ঢালু এবং শুকনো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। বাসস্থানে আলো-বাতাস সরাসরি প্রবেশের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গৃষ্মকালে প্রচন্ড গরম ও শীতকাকে প্রচন্ড ঠান্ডা দ্বারা বাছেগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের মেঝেতে শুকনো খড় বা ছালার চট বিছিয়ে রাখতে হবে। প্রতিটি বাছুরের জন্য ৪ ফুট x ২ ফুট মাপের ঘরের প্রয়োজন। গ্রামীণ পর্যায়ে বাঁশ ও কাঠের সাহায্যে অতি সহজে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব। ঘরে খাদ্য ও পরিষ্কার পানি সরবরাহ করার জন্য পাত্র রাখতে হবে।

খাদ্য ব্যবস্থপনা : জন্মের পর পরই বাছুরকে মায়ের শাল দুধ খাওয়াতে হবে। অনেক বাছুরকেই জন্মের পরে পর্যাপ্ত শাল দুধ খাওয়ানো হয় না ফলে বাছুরের মধ্যে সঠিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় না। শাল দুধ খাওয়ানোর নিয়ম হল দৈনিক প্রতি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১০ কেজি অর্থাৎ ২০ থেকে ২৫ কেজি ওজনের জন্য দৈনিক ১.২ থেকে ১.৫ কেজি দুধ খাওয়াতে হবে। অবশ্যই আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা মধ্যে খাওয়ানো শুরু করা উচিত এই দুধ খাওয়ালে বাছুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বাছুরকে নিয়মিত গাতীর দুধ খাওয়াতে হবে অন্যথায় মিল্ক রিপ্লেসারের মাধ্যমে বাছুরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যান্য সর্তকতা : সদ্যজাত বাছুরকে পানি দিয়ে ধৌত করা সমীচীন হবে না। কারণ পানির সংস্পর্শে আসলে বাছুরের ঠান্ডা লেগে যেতে পারে এবং নানা ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সংকর জাতের বাছুরের প্রায় ৪০ ভাগ ই যথাযত যত্নের অভাবে মারা যায়, ফলে খামারী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এজন্য খামারীকে সদ্যজাত বাছুরের যতœ ও পরিচর্যার প্রতি বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া উচিত।

মোঃ শাহজাহান মিয়া, উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ অফসার, ওসমানীনগর, সিলেট।

Related posts

Leave a Comment

CAPTCHA ImageChange Image