ধ্বংসের হাত থেকে পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচান।

২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদন এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি করা সম্ভাব, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তের দাঁড়িয়ে আমাদের পোল্ট্রি শিল্প। দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে উঠা এই শিল্পটি দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। পোল্ট্রি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখি একটি শিল্প এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। শুধুমাত্র চাকরি নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের যুব সমাজ ছোট ও মাঝারী পুঁজি নিয়ে অর্থকরী শিল্পে পরিণত করেছে পোল্ট্রি শিল্পকে। ব্যাপারটিকে হাল্কা করে দেখার মোটেই অবকাশ নেই। পোল্ট্রি শিল্পের কল্যাণে অনেক বেকার যুবক সফল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছোট ও মাঝারী খামারীরা পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পোল্ট্রি শিল্পের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের নজির আর কোনো শিল্পে লক্ষ্য করা যায়না সবচেয়ে বড় কথা- পোল্ট্রি এমন একটি শিল্প যে শিল্পটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে বাজারজাতকরণ, বাচ্চা এবং খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে বড় ও মাঝারি আকারে শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এই শিল্প থেকে দেশে ডিম এবং মাংস দুটি দেশে প্রোটিন এর চাহিদা পূরণ করছে।

সম্ভাবনাময় ব্যাপক কর্মসংস্থানমুখি পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে অনেক ষড়যন্ত্র, গুজব, আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থে এসব গুজব, আতঙ্ক এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। ত্রিমুখী সমস্যায় চরম দুর্দিনে নেমেছে পোল্ট্রি ব্যবসা। তাঁর ফল ভোগ করছে প্রন্তিক খামারিরা দেশজুড়ে বার্ড ফ্লু’র প্রকোপ ও খাবারের দাম বাড়ার কারণে বন্ধ হচ্ছে অনেক পোল্ট্রি খামার। দেশীয় পুঁজিতে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে রক্ষা করতে এবং কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই।

পোল্ট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় মূলত ৯০ এর দশকে তারও আগে ১৯৬৪ সালে গাজীপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তবে ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশী ও সোনালী জাতের মুরগীর বাইরে উন্নত জাতের লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগীর চাষে খামারিরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। এরফলে দেশের জনগণ স্বচ্ছভাবে ও হাতের নাগালের মধ্যে ডিম ও মুরগীর মাংস খেতে পাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে গেলে এখন দেখা যাবে যেসব পরিবার বছরে ৫/৬ বার মাংস খেতে পেত না সেখানে পোল্ট্রির কল্যাণে তারা সহসাই ডিম ও মাংস খেতে পারছে। মেহমানকে অনাআসে মাংস দিয়ে যতœ করতে পারছে। গ্রামীণ পর্যায়ে এই পোল্ট্রি শিল্পের সুবাদে নারী ও পুরুষরা নিজেদের আর্থিক উন্নয়ন, স্বকর্মসংস্থান এবং অপরের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান পোল্ট্রি শিল্পের সমস্যা শীঘ্রই সমাধান না হলে দেশে ব্যাপক মাংস ঘাটতি দেখা দিতে পারে। পোল্ট্রি ব্যবসা বন্ধ হলে নিম্নবিত্ত জনগণ আর মাংস খেতে পারবেনা।

পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন ও সফলতার পিছনে রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারীরা চাকরীর উপর নির্ভরশীল না করে সীমিত পুঁজি নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন পোল্ট্রি শিল্পকে, সীমাবদ্ধতার মধ্য ধারদেনা করে বাচিয়ে রেখেছেন এই শিল্পকে। বার্ড ফ্লু আতঙ্কে এই শিল্পটি বেশ কয়েকবার ব্যপক ক্ষতির শিকার হয়েছে পুঁজি সর্বস্ব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে অসংখ্য খামারী ও উদ্যোক্তার কর্মসংস্থান হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

২০০৪ সালে প্রথম বার্ড ফ্লু দেখা দেয়ার ফলে দুই বছরে পোল্ট্রি শিল্পে খামারী ও  উদ্যোক্তাদের ক্ষতি হয়েছে ৪১৫০ কোটি টাকা পরবতী ২ বছর  অবস্থার কিছুটা স্বাভাবিক হলেও  ২০১১ সাল থেকে আবারো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে পোল্ট্রি শিল্প। ১৯৯৬-৯৭ সালে থাইল্যান্ডের সি পি বাংলাদেশ কোম্পানীটি পোল্ট্রি শিল্পে বাংলাদেশে প্রথম বিনিয়োগ করে। এর ধারাবাহিকতায় সাতটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান ও ফিড মিলগুলি একচেটিয়ায় ব্যবসা করছে। সাতটি প্রতিষ্ঠানের ভিতর পাঁচটি ভারতের বাকি একটি থাইল্যান্ড এবং একটি চায়নার, জানাগেছে  আরো ৮টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান পোল্ট্রি শিল্পখাতে বিনিয়োগ করতে আসছে বা আগ্রহী।

পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ খামারীদের অভিমত যে, আগের সাতটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান এই শিল্পের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দখল করে রেখেছে। বাকি ৮টি প্রতিষ্ঠান আসলে এই শিল্পের ৫০ থেকে ৬০ ভাগ চলে যাবে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের দখলে। আর তখন মুখ থুবড়ে পড়বে পোল্ট্রি শিল্পে । বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া পোল্ট্রি খামারগুলি  বিদেশী কোম্পানিরা ভাড়া নিয়ে অথবা নাম মাত্র ক্রয় করে লাভজনক ব্যবসা করছে। খতিয়ে দেখতে হবে এই শিল্পে দেশীয় বিনিয়োগ অনিশ্চিত করার পিছনে বিদেশী কোম্পানীগুলোর কোনো হাত আছে কিনা? বাংলাদেশ বিদেশী ব্যবসার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে দেশীয় উদ্যোক্তারা বা খামারীরা তারচেয়ে বেশি সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার রাখে। সম-সুবিধা পেলেও মেধা আর প্রচেষ্টার জোড়ে এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশের খামারীরা।

জাতীয় স্বাথে পোল্ট্রি শিল্প রক্ষার সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবসম্মত ও সূদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বেকারত্ব নিরসনে আমিষের চাহিদা পূরনের লক্ষে খামারিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যাবতীয় সহায়তা দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং খামার পুনঃরায় চালু করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে।

১. পোল্ট্রি শিল্পকে বীমার আওতায় আনতে হবে।

২. পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ ও শুল্কমুক্ত করতে হবে।

৩. দেশের জনগনের খাদ্য তালিকায় ডিম ও ব্রয়লার মাংস সহজ লভ্য প্রাপ্তিতে নিশ্চয়তায় পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিওতে বিজ্ঞাপন আকারে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে উৎসাহ, পুষ্টি ও স্বাদে অতুলনীয় প্রচারে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৪. খামারীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে।

৫. পোল্ট্রি নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে।

৬. ব্রীডার ফার্মগুলোকে ২ সপ্তাহের জন্য ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ করতে হবে।

৭. সরকারি রেজিষ্ট্রেশন ভুক্ত ব্রীডার ফার্ম ও হ্যাচারীদের সোনালি পালন বন্ধ করতে হবে।

৮. ফিডের দাম ৩০-৩৫ এর মধ্যে রাখতে হবে।

৯. বাচ্চার দাম ২৫-৩০ এর মধ্যে রাখতে হবে।

১০. প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিপিসি সম্মিলিত ভাবে কাজ করে মনিটরিং সেলের মাধ্যমে মার্কেট নিয়ন্ত্রন করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারের (উপরে ১০ টি প্রস্তাব) সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, সংগঠন ও মন্ত্রণালয়ের সাথে জরুরী ভিত্তিক আলোচনা করে তার সমাধানের উদ্যোগ নিবে এটাই পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ ও খামারীদের প্রত্যাশা। তাহলে পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাচানো সম্ভব।

Related posts

Leave a Comment

CAPTCHA ImageChange Image